তখন বুঝিনি, এখন বুঝি পরিবারের কাছে শিক্ষার্থীদের খারাপভাবে উপস্থাপন করা, তাদের পারিবারিক জীবন বিষিয়ে তোলা জগন্নাথের শিক্ষকদের চর্চিত এক কঠিন মারনাস্ত্র।
ছাত্র রাজনীতি নয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকবৃন্দের সিস্টেমেটিক নিপিড়নে শিক্ষার্থী খুণের অভয়ারন্যের নাম হলো এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। না, আজ আমি গণমাধ্যমের রেফারেন্সে নয়, নিজের ভাই হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বয়ান দেব!
আমার ভাই শিহাব সিদ্দিকী যে কি-না দীর্ঘরোগ ভোগের পর আমাদের ছেড়ে ২০২৩ সালের ১৮ অক্টোবর তারিখে মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে টিবি মেনিনজাইটিস সহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনটি বছর সে প্রায় অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছে। শয্যাশায়ী হবার আগের ৯টি বছর সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ডিপার্টমেন্টের সাথে পাঞ্জা লড়েছে। বলা যায় বিবিএ ডিপার্টমেন্টের তৎকালীন সভাপতি ও অন্যান্য শিক্ষকদের নিপিড়নের শিকার হয়ে মানসিক বিপর্যস্ততা থেকেই তার গায়ে বাসা বাঁধে মরণরোগ।
আমার ভাইটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তেই চায়নি। সে হয় মেডিকেল না হয় বাংলা সাহিত্য- দুইটার একটা পড়তে চেয়েছিলো। মেডিকেলে চান্স পায়নি, বাংলায় পরিবারের অমত থাকায় সে নিজের মৃত্যুর একাউন্ট খুলেছিলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং বিভাগে।
২০১৩ বা ২০১৪ সালের কোনো একটা সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক শিক্ষক আমাকে ফোন করেন। আলোচনার বিষয়বস্তু অনেকটা নিচের মতোঃ
শিক্ষকঃ আপনি কি শিহাব সিদ্দিকীর বড় ভাই?
আমিঃ হ্যা।
শিক্ষকঃ আপনার ভাই এর দিকে খেয়াল রাখবেন। ও তো মনে হয় নেশা করে।
আমিঃ হতেই পারে না। সে ধূমপান পর্যন্ত করে না।
শিক্ষকঃ নিজের ভাই বলে এমন মনে হয়, তার উপর নজর রাখবেন, না হয় আমরা তাকে ইউনিভার্সিটি থেকে বের করে দেব!
আমিঃ আপনারা লোকো পেরেন্টিস। শিক্ষার্থী আপনাদের সন্তানের মতো। তারা অধিকাংশ সময় আপনাদের কাস্টডিতে থাকে। আমরাও আপনাদের উপর বিশ্বাস রেখে আমার ভাই কে পড়তে পাঠিয়েছি। আপনারা তার চরিত্র হনন করছেন কি-না সেটি বিবেচনায় রাখবেন।
শিক্ষক ক্ষেপে গিয়েছিলেন, আমাকেও কিছু আজেবাজে কথা শুনিয়ে ফোন রেখেছিলেন।
আমারও প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়েছিলো ওই শিক্ষকের উপর। আমার ভাই এর উপরেও। আমি আমার আব্বাকে সাথে সাথে ফোন করলাম। আব্বা জানালেন তাকেও এক শিক্ষক ফোন করেছিলেন! আব্বাকে নেশার কথা বলেনি, বলেছে “আপনার ছেলে প্রেম করে, মারামারি করে, তাকে সাবধান হতে বলবেন।”
একটা বিশ্ববিদ্যালয় একটা শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের কাছে ফোনে ফোনে একেক রকম অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছে- এটা আমার নিকট অদ্ভুত লেগেছিলো। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি পরিবারের কাছে শিক্ষার্থীদের খারাপভাবে উপস্থাপন করা, তাদের পারিবারিক জীবন বিষিয়ে তোলা জগন্নাথের শিক্ষকদের চর্চিত এক কঠিন মারনাস্ত্র।
আমি আমার ভাই এর সাথে সরাসরি দেখা করে কথা বলি। সে যা জানালো তা শোনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! মূলত তার এক নারী সহপাঠীকে অন্য একজন সহপাঠী নিয়মিত উত্তক্ত করত। আমার ভাই বিষয়টি লক্ষ্য করে ছেলেটিকে একদিন সাবধান করে। কেনো মেয়েটির পক্ষে আমার ভাই কথা বল্ল এই অভিযোগে ৫/৬ জন সন্ত্রাসীগোছের একটি দল নিয়ে আমার ভাইকে লাঞ্চিত করে উত্তক্ত্যকারী ছেলেটি। আমার ভাই আত্মরক্ষায় আক্রমনকারীদের পাল্টা আক্রমন করে এবং পেরে না উঠে পালিয়ে জীবন বাঁচায়।
ওখান থেকেই শুরু। ডিপার্টমেন্টের সভাপতি ও অন্যান্য শিক্ষকরা অজ্ঞাতকারণে সন্ত্রাসী গোছের ছেলেগুলোর পক্ষ নিয়ে শুরু করে আমার ভাই এর উপর অত্যাচার। পরিবারের কাছে ফোন দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে পরিবারের কাছে আমার ভাই কে প্রশ্ন বিদ্ধ করে তুলে। পরীক্ষার খাতায় সব ঠিকঠাক লিখার পরেও অজ্ঞাতকারণে ধারাবাহিকভাবে কম নম্বর পেতে থাকে। তাতে আমার ভাই এর উপর পরিবারের চাপ বাড়তে থাকে। মানসিকভাবে সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এক পর্যায়ে আমরা তাকে নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হই। চিকিৎসক তাকে চাপমুক্ত রাখতে বলেন। নিয়মিত কাউন্সেলিং করাতে বলেন। একেটা কাউন্সেলিং সেশনে এক হাজার টাকা লাগত। আমরা সপ্তাহে বড়জোর দুইটা সেশন করাতে পারতাম। তার আচরণে মুগ্ধ হয়ে অনেক সময় চিকিৎসক বিনা পয়সায় কাউন্সেলিং দিত। কিন্তু আমার ভাইটা পড়াশোনা থেকে ক্রমশই নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিতে থাকে। আমরা চিন্তিত হয়ে পরি। এর মধ্যে এক বছর ডিপার্টমেন্ট ফেইল করিয়ে দিলো, আরেক বছর আমার ভাই নিজেই হতাশা থেকে পরীক্ষায় বসলো না। চারপাশের মানুষ ও কথিত স্বজনদের প্রশ্নবাণ- বিবিএ কি শেষ হইছে? ভাইটা আমার এই প্রশ্ন নিতে পারত না!
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ সফলতার পথে! আমার ভাইটা আর ডিগ্রী নিয়ে বেরুতে পারবে না! এসএসসি তে এ প্লাস, এইচএসসি তে ভালো রেজাল্ট, জীবনে ধূমপান না করা ছেলেটা, অসম্ভব রকমের জেন্ডার সচেতন ছেলেটা শিক্ষকের থেকে নেশার বদনাম পেলো, প্রেম করে মারামারির খেতাব পেলো, আর এখন ডিগ্রী ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার পথে! স্বজনরা মুখিয়ে আছে নানান কথার অস্ত্র সাজিয়ে!
আমি লিগ্যাল নোটিশ এর মতো করে কিছু একটা তৈরী করলাম যাতে করে অন্তত অসুস্থতার কারণে পরীক্ষা না দেয়ার অপরাধে আমার ভাই কে বিশ্ববিদ্যলয়ের কোনো নিয়ম পরীক্ষায় বসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে না পারে। লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ার আগে আমি সেই চিঠি নিয়ে তৎকালীন ভিসি ড. মিজানুর রহমান স্যারের সাথে আমার ভাই সহ দেখা করলাম এবং বিস্তারিত বল্লাম। স্যার সভাপতির বিরূপ আচরণ নিয়ে কিছু না করলেও আমার ভাই কে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দিলেন। আমার ভাই কোনো রকমে অনার্স পাশ করলো। এমবিএ ভর্তী হয়ে কিছু ক্লাশ করতে না করতেই আমার ভাই আবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেলো। বিশেষ করে যেখানে সে অন্যায় দেখত সেখানে সে ভায়েলেন্ট হয়ে যেতো। আমরা বুঝাতে চেষ্টা করলাম- এগুলো স্বাভাবিক সে যেনো শুধু পড়ালেখায় মন দেয়! কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষা জীবনটা, তছনছ করে দেয়ার তার ভেতরে যে ক্ষোভ তৈরী হয়েছিলো সেটি সে নিজের উপর টর্চার করে মানসিক কষ্ট হ্রাসের চেস্টা করত। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলো। সামাজিক যোগাযোগ কমিয়ে দিলো।
এর পর ২০২০ সালের কোভিডের সময় নিজে কোভিডে আক্রান্ত হলো। কোভিড তার ভেতরে আগে থেকেই বাসাবাঁধা টিবি ট্রিগার করালো। স্ট্রোক হলো। বিছানায় নিথর দেহ পড়ে থাকতে থাকতে বেড সোর হলো বড় বড়। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করলাম তাকে সুস্থ করে তুলতে। সব চেষ্টা ব্যার্থ করে আমার ভাইটা আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলো!
অবন্তিকা সহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আচরন জানার পরে মনে হচ্ছে আমার ভাইটাও বলী হয়েছে জগন্নাথের শিক্ষকদের কিলিং মেশিনে! ওদের সবার কাহীনী একই রকম!
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তী না হলে আজ আমার ভাইটা সম্ভবত অকালে মারা যেতো না।
আমি লক্ষ্য করেছি জগন্নাথের শিক্ষকদের এই কিলিং মেশিনে শিক্ষার্থীর প্রাণ নিয়ে নেয়ার পরে শিক্ষার্থীর উপরেই দোষ চাপানোর একটা প্রবণতা রয়েছে। ডিপ্রেশন বা তথাকথিত এরূপ রোগশোকের উপরে দোষ চাপানোর অপচেষ্টা এই বিশ্ববিদ্যালয় জোটবদ্ধভাবে করে থাকে। অবন্তিকার মায়ের অভিযোগ কে “মায়ের আবেগজনীত” বলে হাল্কা করার অপপ্রয়াসও লক্ষ্য করছি।
আমার ভাই, অবন্তিকা সহ অনেকে প্রাণ দিয়ে প্রমান করে গিয়েছে কিভাবে শিক্ষকরা তাদের মানসিক পরিস্থিতিকে আত্মহত্যা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছেন। এগুলো ৩০৬ না, পরিষ্কার হোমিসাইড, ৩০২ এর সমগ্র উপাদান বিদ্যমান এই হত্যাকান্ডগুলোতে!
জগন্নাথে শত শত শিক্ষার্থী নিশ্চয়ই মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা যদি তাদের বাঁচাতে চাই তাহলে এই মূহুর্তে শিক্ষকদের এই কিলিং মেশিন স্তব্ধ করে দিতে হবে।
Leave a Reply